অভাগা শিশুদের দুর্ভাগা স্কুল বরগুনার দক্ষিণ খাজুরতলা আদর্শগ্রাম বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

নুরুল আহাদ অনিক:

বরগুনার দক্ষিণ খাজুরতলা আদর্শ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। সহস্রাধিক হতদরিদ্র পরিবারের প্রায় ছয় শতাধিক শিশুর একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় এটি। বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের দক্ষিণ খেজুরতলা গ্রামে অবস্থিত এ বিদ্যালয়টির আশেপাশে রয়েছে গৃহহীন হতদরিদ্র্র পরিবারের জন্য নির্মিত সরকারের তিনটি আবাসন প্রকল্প।

শত প্রতিকূলতাকে মাথায় নিয়ে এখনও নিভু নিভু হয়ে জ্বলছে এ বিদ্যালয়টি। ইতোমধ্যেই শত শত শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। বিশেষ করে করণা মহামারীর সংকটে পড়ে সম্ভাবনা থাকা সত্বেও অনেক শিশু স্কুল ছেড়ে গেছে। কেউ কেউ কাজ নিয়েছে ওয়ার্কশপে, কেউ বা মিস্ত্রিদের সহযোগী হিসেবে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজমল হুদা মিঠু বলেন, “গত ১৪ বছর ধরে কত যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, সীমাবদ্ধতা আর প্রতিকূলতার মাঝে স্কুলটি টিকিয়ে রাখতে হয়েছে তা বলে বোঝানো যাবে না।” অন্যের জমি বর্গা চাষ করে জীবন চলে তাঁর। তার পিতা মোঃ শাহজাহান একজন মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি আরও বলেন, দরিদ্র পরিবারের সস্তান হয়ে তিনি বুঝেছিলেন দরিদ্র শিশুদের যন্ত্রনার মর্মবেদনা। তাই গত ১৪ বছর ধরে হতদরিদ্র পরিবারের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে স্থানীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় নিজ উদ্যোগে দক্ষিণ খাজুরতলা আদর্শগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে বিনা পয়সায় পাঠদান করে আসছেন।

যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ২০০৬ সালে। এর পরপরই ২০০৭ সালের ১৫ ই নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরের কবলে পড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় পুরো গ্রাম। আবারও ঘুরে দাঁড়ায় তারা। আশেপাশে গৃহহীন দরিদ্র পরিবারের জন্য নির্মিত তিনটি সরকারি আবাসন প্রকল্প রয়েছে। যেখানে সহস্রাধিক দরিদ্র্র পরিবারের বসবাস।

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোঃ হাবিবুর রহমান বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে গত ১০ বছর ধরে আমরা স্কুলটির জন্য বরাদ্দকৃত জমি স্কুলটির নামে আনতে পারিনি। প্রায় ১০ বছর ধরে প্রচেষ্টার পর সম্প্রতি বদলি হয়ে যাওয়া জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহর প্রচেষ্টায় দক্ষিণ খাজুরতলা আদর্শগ্রাম বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে জমি প্রদান করা হয়।

তিনি আরও বলেন, সব স্কুলের শিক্ষার্থীরা উপবৃত্তি পেলেও হতদরিদ্র পরিবারের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের এই বিদ্যালয় উপবৃত্তির সুযোগ নেই। তাই গত ১০ বছরে আমাদের চোখের সামনে ঝরে গেছে হতদরিদ্র পরিবারের কয়েকশত শিশু। জড়িয়ে পড়ছে শিশুশ্রমে।

দক্ষিণ খাজুরতলা আদর্শগ্রাম বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক মোহাম্মদ রফিক মিয়া (৪৫) বলেন, “করোনা আমাদের আরো দরিদ্র্র বানিয়ে গেছে এখন খাওয়া পরা নিয়ে চিন্তায় আছি ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার চিন্তা করার সময় কই?”

এ বিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র মোঃ নাঈম (৯) জানায় তার লেখাপড়ার বড় ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে চাকরি করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু অভাবের কারণে স্কুল ছেড়ে এখন ওয়ার্কশপে কাজ নিতে হয়েছে তার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্কুলটিতে এখনো প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। শুরু থেকে এ পযর্ন্ত প্রধান শিক্ষকসহ অপর তিনজন নারী শিক্ষিকা বিনা বেতনে নিয়মিত পাঠদান করে আসছেন।

এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এম এম মিজানুর রহমান জানান, শুনেছি আশেপাশের কয়েক শত হতদরিদ্র পরিবারের একমাত্র বিদ্যালয় এটি। এতদিন জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে আটকে ছিল এই স্কুলটির জাতীয়করণ। আর এখন যেহেতু আপাতত আর কোন বিদ্যালয় নতুন করে সরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেই সেহেতু এ স্কুলটির জাতীয়করণে আবারো জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া স্কুলটির জন্য তেমন কিছুই করার নেই তাঁর।

এ বিষয়ে বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, হতদরিদ্র পরিবারের শতশত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্যে স্কুলটি অনেক আগেই জাতীয়করণ করা দরকার ছিলো। আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু নানা জটিলতার কারণে তা আর এগোয়নি। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।

Spread the love
       
 
 
    

Leave a Reply

Your email address will not be published.