চিত্তরঞ্জন শীল
দল, মত, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে ঐতিহ্যের ধারাবহিকতায় বরগুনার শিমুলতলা বৈশাখী মেলা ৪২ বছরে পা দিচ্ছে। করোনাকালে এর ছেদ ঘটলেও এবার নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বরগুনাবাসীর প্রাণের বৈশাখী মেলা ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। দেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা সদরে আয়োজিত এ মেলায় সমবেত হয় হাজার হাজার লোক, মিলন ঘটে এলাকার লোকসংস্কৃতি সেবকদের।
মেলার নগরী বরগুনায় সারা বছরই কোননা কোন মেলা/উৎসব থাকে। এর মধ্যে বৈশাখী মেলা, ইলিশ উৎসব, জোছনা উৎসব, নবান্ন উৎসব, বসন্ত মেলা, রাখাইন, খৃষ্টানসহ বিভিন্ন দিবসে লোকজ ও ধর্মীয় মেলা/উৎসব। একসময় বরগুনার বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে ১লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গ্রামে গঞ্জে লোকজ উৎসব ও মেলার আয়োজন করা হলেও করা হত। ১৯৮১ সালে প্রথম বরগুনা জেলা সদরের শিমূলতলায় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনায় আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। এ মেলাই ধারাবহিকতা অর্জন করতে চলেছে ৪২ বছরের। সামাজিক উদ্যোগে এ মেলা বর্তমানে জেলা প্রশাসন আয়োজনে থাকলেও এলাকার সকল শিল্পী এবং সমাজের একটি বড় অংশ এ মেলার প্রষ্ঠপোষকতা করে আসছে।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী শংকর শাওজাল ১৯৮১ সালের মার্চ মাসের শেষে বরগুনায় এসে সাস্কৃতিক কর্মীদের উৎসাহিত করে প্রথম শুরু করেন শিমুলতলায় বৈশাখী মেলার। এ সময় মহকুমা শহরে ডেপুটি সিভিল সার্জন ছিলেন ডা: এ আর বিশ্বাস। তিনি এ আয়োজনে প্রধান পৃষ্ঠপোষকের দায়িত্ব নেন। সে সময় মহকুমা প্রশাসক এ বি এ চৌধুরীও পরোক্ষ সহয়োগিতা করেন।
তখন শিমূলতলা ছিল বরগুনার মূল শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ’৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের এক পর্বে মুক্তিযোদ্ধারা বরগুনা দখলের লক্ষে শিমূলতলা থেকে প্রথম ফায়ার ওপেন করে স্থানটি উল্লেখযোগ্য করে রাখে। শংকর শাওজালের দেশের বাড়ি পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলায়। তিনি তখন পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি এলাকায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িত থেকে সবে মাত্র ঢাকা শহরে উঠি উঠি করছেন। তার সাথে সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিতেন এলাকার সঙ্গীত শিল্পী মো: জহিরুজ্জামান। তারা বরগুনা এসে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর আহবানে সকল শিল্পী কলা কুশলীদের নিয়ে বরগুনা সিরাজ উদ্দিন টাউন হলে সভার আয়োজন করেন। সেদিন আয়োজকদের মধ্যে ছিলেন এলাকার বিশিষ্ঠ সঙ্গীত শিল্পী নৃত্যগোপাল সমদ্দার, সুখরঞ্জন শীল, বর্তমাণে পটুয়াখালীর জেলা ও দায়ারা জজ রোখসানা পারভীন বেঞ্জু, আভা রানী কর্মকার, জাহান্দার শাহ, জহিরুজ্জামান, চিত্তরঞ্জন শীল, রমারানী কর্মকার, মোস্তাক আহাম্মেদ, হাসানুর রহমান ঝন্টু, শেখর বরণ দাস, সন্তোষ কর্মকার, শাহানাজ পারভীন লিলি, রফিকুল আলম খোকন, ইকবাল হোসেন ,কল্পনা দাস, স্বপন দাস, লিয়াকত হোসেন জুয়েল , মনিরুল ইসলাম, মো: শাহ আলম, পাথরঘাটার বিউটি ও পংকজ। সভার পরে ডা: এ আর বিশ্বাসের স্টাফ কোয়াটারের বাসায় শুরু হয় মহড়া। ঠিক হয় শিমূলতলায় বর্তমাণ ডায়াবেটিক সেন্টারের পাশে ঢাকার ছায়ানটের মত প্রভাতী অনুষ্ঠানের আয়োজন।
প্রথম বছর আয়োজন ছিল সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রভাতী অনুষ্ঠান, বাঙ্গালী ভোজ এবং বিকেলে নীল নাচের অনুষ্ঠান। মেলা না হলেও বর্ষবরণ উপলক্ষে প্রচুর দোকানপাটের সমাগম হয় প্রথম বছর। মহকুমা প্রশাসক এ বি এ চৌধুরী সকাল বেলা বৈশাখী মঞ্চে বরগুনাবাসীর উদ্দেশ্যে নববর্ষের শুভেচ্ছা ভাষণ দেন। প্রথমবার প্রভাতী অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেন শংকর শাওজাল। তার গ্রন্থিত পান্ডুলিপি ছিল ”সামনে জগদিশ বাবুর বাড়ি নয়, লাল ফুলের সাজানো বাগান।” ধারা বর্ণনায় ছিলেন নৃত্য গোপাল সমদ্দার ও শাহানাজ পারভীন লিলি।