স্টাফ রিপোর্টার
২০০০ সালে পিরোজপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কচা নদীতে একটি সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। সেতুটির নাম অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু।
আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে বরিশাল থেকে সড়কপথে পিরোজপুর হয়ে খুলনা যেতে ফেরি পার হতে হতো ৮টি। যে পথে বরিশাল থেকে খুলনা যেতে হতো, সে পথের ঘাটে ঘাটে নানা ভোগান্তি ও ভয় ছিল। যাত্রীরা সারাদিনের বন্দোবস্ত করে এ রুট পার হতেন।
তবে ৯০ দশকের দিক থেকে ধীরে ধীরে একের পর এক সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে ফেরিগুলো বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। বরিশাল বিভাগ থেকে আশপাশের বিভাগীয় জেলাশহরে যেতে সেতু নির্মিত হতে থাকলেও স্রোতস্বিনী, ভয়ঙ্কর উত্তাল কচা নদীর বেকুটিয়া পয়েন্টে সেতু নির্মাণের কথা ভাবেনি তৎকালীন কোনো সরকার। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে বেকুটিয়া ফেরিঘাটই ছিল একমাত্র ভরসা। এখন সেখানে সেতু নির্মিত হয়েছে। ২০০০ সালে যে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৮৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুটির কাজ শেষ হবে চলতি অর্থবছরের ৩০ জুন। আগস্ট মাস নাগাদ সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চাকরি সুবাদে বরিশাল-পিরোজপুর, বাগেরহাট ও খুলনায় জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান। সেতু প্রসঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটছে। যার ফলে বরিশাল থেকে সাগর-কন্যা কুয়াকাটা পর্যন্ত যেতে এখন একটিও ফেরি পার হতে হয় না। যেখানে একসময় যেতে ৬টি ফেরি পার হতে হতো। আবার ২০১৮ সালে কচা নদীর ওপর বেকুটিয়া পয়েন্টে অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হলে মানুষ নতুন আশার আলো দেখতে পায়।
বরিশাল নদী বন্দর থেকে গোপালগঞ্জ হয়ে খুলনা যেতে পাড়ি দিতে হবে ১৪৯ কিলোমিটার পথ। যেখানে ৪০ কিলোমিটার গতিতে চলা একটি যানবাহনের প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হবে। অপরদিকে বরিশাল নদী বন্দর থেকে পিরোজপুর হয়ে খুলনা যেতে পাড়ি দিতে হবে ১১৮ কিলোমিটার পথ। যেখানে ৪০ কিলোমিটার গতির একটি যানবাহনকে মাত্র ৩ ঘণ্টা সময় ব্যয় করতে হবে।
বর্তমানে বরিশাল-পিরোজপুর-বাগেরহাট-খুলনার সড়কপথ এতোটাই সুন্দর যে আড়াই ঘণ্টায় অনায়াসে খুলনা পৌঁছান যাবে। বর্তমানে এ সড়ক দিয়েই খুলনা যেতে ৪ থেকে সাড়ে ৪ ঘণ্টা সময় লাগছে শুধু বেকটিয়া ফেরির জন্য।
জাকির হোসেন একজন বাসচালক। এ রুটে নিয়মিত বাস চালান। তিনি বলেন, বরিশাল থেকে খুলনা রুটের ভোগান্তির আরেক নাম বেকুটিয়া-কুমিরমারা ফেরিঘাট। এ ঘাট দিয়ে ফেরিতে একবার উঠতে না পারলে পরের ফেরি পেতে ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। যত প্রয়োজনীয়তাই থাক না কেন; একটার বেশি ফেরি চলে না বেশিরভাগ সময়। এতে ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা। বেকুটিয়ায় নির্মিত অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ ভোগান্তির শেষ হতে চলছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ সেতু চালুর মধ্য দিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে গতি আসবে। পিরোজপুর থেকে বিভাগীয় হেডকোয়ার্টার বরিশালের সঙ্গে সড়কপথের যোগাযোগ সহজ হওয়ার পাশাপাশি, বরিশাল হয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাও সহজ হবে।
জানা গেছে, খুলনার নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ স্থাপনসহ কুয়াকাটা-সুন্দরবন, পায়রা-মোংলা সমুদ্রবন্দর, বরিশালের সঙ্গে বেনাপোল ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরসহ অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ শহর-গ্রামের সঙ্গে যুক্ত হবে বরিশাল।
অষ্টম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ও বরিশাল সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুম মাহমুদ সুমন জানান, সেতু নির্মাণে সব কাজই প্রায় শেষের পথে। যেকোনো সময় এ সেতু উদ্বোধন হতে পারে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) জানিয়েছে, ন্যাভিগেশন রুট ও উচ্চতা ঠিক রেখে নির্মিত মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৯৯৮ মিটার, প্রস্থ ১৩ দশমিক ৪০ মিটার, অ্যাপ্রোচ সেতুর দৈর্ঘ্য ৪৯৫ মিটার এবং অ্যাপ্রোচ সড়কের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৬৭ মিটার।
জিটুজি পদ্ধতিতে সেতুটি নির্মাণ করে চীনের চায়না রেলওয়ে সেভেনটিন ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। চীন সরকারের অর্থায়নে ৮৯৪ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ৯৯৮ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতুটি নির্মিত হচ্ছে।