স্টাফ রিপোর্টার
‘আমার বাজানে এবার ক্ষেতে তরমুজ দেছে, তরমুজ ভালো হইলে বেইচা আমাগো লেখাপড়ার পিছনে খরচ করতে পারবে। সামনে আমাদের বড়ই সুখের সময়’ কিছুদিন আগে বরগুনা সদরের ‘মাঝের চর’ গ্রামের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মারুফা আক্তার এমন আশার কথাই জানিয়েছিলো।
কিন্তু বরগুনাসহ উপকূলীয় এলাকাসমূহে কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ কৃষক পরিবারে এখন আশার নৈরাশ্যের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপকূলীয় মাটি ও আবহাওয়া তরমুজ চাষের উপযোগী হওয়ায় ক্রমশই তরমুজ চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফার আশায় উপকূলের কৃষকরা ব্যাপকভাবে ঝুঁকছেন তরমুজ চাষে। একই সাথে তরুণ উদ্যোক্তারাও আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন তরমুজ চাষে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছর বরগুনা জেলায় প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদিত তরমুজ ৩০০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়েছে।
অধিক মুনাফার আশায় এবছরও কৃষকরা আগে থেকেই আঁটঘাট বেঁধে তরমুজ চাষে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন। অনেকে ইতোমধ্যেই আগাম তরমুজ চাষে বেশ লাভবানও হয়েছেন। কিন্তু এরই মাঝে অকালে বাদলা হয়ে কৃষকের চোখে হতাশার সৃষ্টি করে টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গত ৫-৬ দিন উপকূলে গড়ে ২০-৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে এবং একদিন শিলা বৃষ্টিও হয়েছে। শিলা বৃষ্টিতে তরমুজসহ অন্যান্য ফসল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বরগুনা সদরের ৬ নং বুড়িরচর ইউনিয়নের মজিবুর রহমান জানান, ‘এ বছর আমি ২৬ একর জমিতে তরমুজের চাষাবাদ করছি, কিন্তু এই বৃষ্টিতে ক্ষেতে যে হারে পানি আইটকা রইছে, তাতে আসল টাকা নিয়া ক্ষেত দিয়ে ওঠা দায়!’
সদরের ৯ নং বালিয়াতলী ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান জানান, ‘আমি এ বছর তিন একর জায়গায় তরমুজ দেছেলাম। সরকারি ভাতার টাকা সবই তরমুজ ক্ষেতের পিছেই শেষ করছি। এরকম বৃষ্টি হইলে চোখে আন্দার দেহা ছাড়া উপায় নাই!’
শিলাবৃষ্টির কারণে ইতোমধ্যেই একরের পর একর জমির তরমুজ নষ্ট হয়েছে। চাষিরা বলছে, তাদের অনেক তরমুজেই শিলার দাগ লেগে আছে এবং সেখান থেকে পচন ধরছে। অন্যদিকে, জমিতে পানি আটকে থাকায় অনেকের তরমুজের চারাই ভেসে রয়েছে। ফলে তরমুজ গাছের গোড়া পঁচে গাছসহ ফলটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
বরগুনা সদরের তরমুজ চাষী আবু হানিফ বলেন, ‘এনজিও থেকে চড়া সুদে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়া
৩ হেক্টর জমিতে তরমুজ দিছি। কিন্তু যে বৃষ্টি হইছে, এই ঋণ শোধ করমু ক্যামনে হেই চিন্তায় এখনো হুশ জ্ঞান নাই।’
শুধু বরগুনা সদরই নয়, আমতলী, তালতলীসহ জেলার সকল উপজেলার চাষীদের একই দশা। এখন সকল তরমুজ চাষি রাতদিন ব্যস্ত মাঠে সেচের মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন নিয়ে। অনেকের জমিতে পানি এমনভাবে আটকে আছে যেগুলো নিষ্কাশন হতে হতে তরমুজ চারা পচে যাবে। অনেকে আবার বৃষ্টি পানি নিষ্কাশন শেষে জমিতে কীটনাশক ও পচনরোধক ওষুধ প্রয়োগ করছেন।
আমতলী উপজেলা তরমুজ চাষী মোঃ ফারুক জানান, ‘এই বৃষ্টি আর ১০-১৫ দিন পরে হলেও তার আগে কয়েক চালান ঢাকায় পাঠানো যেত। কিন্তু বৃষ্টি না থামলে আমরা ভোগান্তির শিকার হবো।’
এবারের তরমুজ চাষকে কেন্দ্র করে প্রান্তিক পর্যায়ে গড়ে উঠেছিল সার ও কীটনাশকের দোকান। সেসব সার ও কীটনাশকের দোকান থেকে এখন শুধু পচনরোধক ঔষধ বিক্রির হিড়িক।
বরগুনা সদরের মাওয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী গোলাম কিবরিয়া জানান, ‘ বৃষ্টির কয়েকদিন ধরে তরমুজ চাষীরা শুধু সিরাজিন, জি- মেটালিক্স ঔষধ ক্রয় করছেন। এর প্রয়োগে তরমুজের পচনরোধ হয়’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবু সৈয়দ মো. জোবায়দুল আলম জানান, ‘তরমুজ চাষীদের জন্য আমাদের দুয়ার সব সময় খোলা। ইতোমধ্যেই কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে আমাদের কৃষি অফিসের লোকজনও তরমুজ ক্ষেতে ছুটছেন। ভারী বর্ষায় তরমুজ পচনরোধে কৃষকদের করণীয় বিষয় ও এ সময়ে ক্ষেতে কি কি ওষুধ দেওয়া যায় সেটা আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োগ করলে কৃষকরা বড়রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হবে না।’
কিছুদিন আগেই জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, ‘এবছর প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের সম্ভাবনা রয়েছে এবং সেখান থেকে উৎপাদিত তরমুজ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি বাজারমূল্যে বিক্রি হতে পারে।’
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত তরমুজ চাষীদের একটা তালিকা করে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে, যাতে কৃষকরা নূন্যতম হলেও উপকৃত হয়।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এবছরই প্রথম তরমুজ চলে যাবে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, উপকূলের অর্থনীতি হবে সম্মৃদ্ধ। কিন্তু জমি থেকে তরমুজ ওঠার আগে এমন লাগাতার বর্ষণে হা-হুতাশ বরগুনার তরমুজ চাষী ও ব্যবসায়ীদের।
উপকূলীয় চাষীরা তরমুজকে ঘিরে যে স্বপ্ন সাজিয়েছেন দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হওয়ার। সে স্বপ্ন এখন স্রষ্টার দয়ার উপরই নির্ভরশীল। সামনের একমাস ভারী বর্ষণ না হলে পদ্মা সেতুর বদৌলতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রবৃদ্ধি ২.৩% বাড়াতে একটা বড় রকমের অবদান রাখবে উপকূলের তরমুজ।