সোহেল হাফিজ
বরগুনার সার্কিট হাউস মাঠ সংলগ্ন জেলা পুলিশ অফিসের পাশে লেকের পাড়ে ৩০টি কৃষ্ণচূড়ার চারা রোপন করেছেন আমাদের প্রিয় বেনজু আপা। শুধু রোপনই নয়। রোপনপরবর্তী রক্ষানেবেক্ষনের দায়দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি।
এর আগে গতবছর সার্কিট হাউস মাঠের লেকপারে তিনি তিন তিনটি লাল কদম লাগিয়েছিলেন। রোপনপরবর্তী নিয়মিতরেক্ষাবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে সেসব গাছে এবার ফুলও ফুটেছিলো। কদম সাধারণ হলুদ হয়ে থাকে কিন্তু তার লাগানো এ কদম ভিন্ন প্রজাতির। বর্ষা এলে শত শত কদম ফুটবে তবে তার সবই লাল। এমন অভাবনীয় এক অদ্ভুদ দৃশ্য দেখাের প্রতীক্ষায় রয়েছি আমরা।
আমরা অনেক সময় সস্তা জনপ্রিয়তার খোঁজে, লোক দেখাতে, কখনও বা উপরোস্থ নির্দেশনা বাস্তবায়নে দায় সারাভাবে বৃক্ষ রোপন করে থাকি। যা ছবি তোলা পযর্ন্তই টিকে থাকে। পরের দিন আর সেসব গাছের অস্তিত্ব থাকে না। নিজ গ্রাম, শহর কিংবা জেলাকে সুন্দর করতে এমপি, মন্ত্রী, মেয়র কিংবা চেয়ারম্যান হওয়ার যে প্রয়োজন পড়ে না তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন একজন রোখসানা বেনজু।
রোখসানা বেনজু একাধারে একজন সঙ্গীত শিল্পী ও সংস্কৃতজন। ছেলেবেলা থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ঋদ্ধ যার জীবনবোধ। ছাত্রজীবন থেকেই রেডিও টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন রোখসানা বেঞ্জু। বরগুনার সাংস্কৃতিক অঙ্গণে রয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। আটপৌরে সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে একজন রোখসানা বেনজু তাঁর শৈশব-কৈশরেই প্রমান করেছেন নারীরা শুধুই নারী নয়। ধর্মীয় গোড়ামী আর সামাজিক কুসংস্কারকে ভেঙে চুড়ে একাকার করে দিয়েছেন তিনি বারবার।
বাঙালি সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করে অদম্য মেধা, কঠিন শ্রম আর আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে বরগুনায় যে ক’জন নারী আজ অনুসরণীয়, তাঁদের মধ্যে রোখসানা বেনজু অন্যতম প্রধান। রোখসানা বেনজু দক্ষিণবঙ্গের প্রথম নারী যিনি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশাত্ববোধের তাগিদে নিজেকে যিনি সঁপে দিয়েছেন দেশ ও জাতির কল্যাণে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় শত প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে নিজেকে যিনি দাঁড় করিয়েছেন নারী জাগরণের অগ্রপথিক হিসেবে। বর্তমানে পটুয়াখালী জেলার প্রথম নারী জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
সরকারি চাকুরে বাবা। টানাপোড়েনের সংসার। একদিকে পাঁচ ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার খরচ। তারওপরে ভাইপো আর ভাতিজীদের লেখাপড়ার অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে বাবার হিমশিম অবস্থা। অন্যদিকে নারী হয়ে জন্মানোর জ্বালা তো আছেই। নতুন বইয়ের গন্ধ পওয়া হয়নি তাঁর। বড়বোনের পুরোণ বই পড়েই এগিয়ে চলে তাঁর লেখাপড়া। এমনই এক কঠিন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দীর্ঘদিনের স্বপ্নটা যখন ফিকে হয়ে আসে ঠিক তখনই তিনি জিদ ধরেন স্বপ্ন পূরণের।
গানের টিউশনির পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিণায় নিজের ছোট্ট বাগানের ফলফলাদি বিক্রী করে উপার্জিত সামান্য কিছু অর্থ হাতে নিয়ে অনেকটা জোর করেই বাবার সাথে যিনি লঞ্চে উঠে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁর।
কখনও আন্ত হল কখনও বা আন্ত বিশ্ববিদ্যালয় সাইকেল রেস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, কেরাম, আর সংগীত প্রতিযোগিতায় একের পর এক সাফল্যের সাথে সাথে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সবার প্রিয় হয়ে ওঠেন রোখসানা বেনজু। লেখাপড়ার পাশাপাশি সমান তালে চলতে থাকে তাঁর টিউশনি। রেডিও টেলিভিশনে চলতে থাকে তাঁর সংগীত সাধনা। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিজের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়েও তাঁর হাতে থাকে বাবা-মা আর ছোট ছোট ভাইবোনের জন্যে শপিংয়ের খরচ।
সেই কৈশোর থেকেই গার্লস গাইড এবং রেডক্রস ভলানটিয়ার হিসেবে মেধার স্বাক্ষর রাখেন রোখসানা বেঞ্জু। স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও সবার থেকে এগিয়ে থাকতেন তিনি। বরগুনার শিমুল তলায় যেসব সংস্কৃতজনদের প্রচেষ্টায় শুভ সূচণা হয় বাংলা ও বাঙালির সার্বজনীন উৎসব বৈশাখী মেলার, তাঁদের মধ্যে রোখসানা বেনজু অন্যতম। এছাড়া বরগুনার ইতিহ্যবাহী জোছনা উৎসবের সূচনালগ্নের অন্যতম প্রধান জোছনাসারথী ছিলেন তিনি।
রোখসানা বেনজুর পিতা অ্যাড. মো. বেলায়েত হোসেন ছিলেন একজন নিভৃতচারি কল্যাণ সাধক। বরগুনার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়াঙ্গণের উন্নয়নে রয়েছে যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান। অ্যাড. বেলায়েত হোসেন জেলা তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে আবসরে এসে যুক্ত হন আইনপেশায়। বাবার সুবাদে ছেলেবেলা থেকেই মুক্তচিন্তা ও অনন্য এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠেন রোখসানা বেঞ্জু।
পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার বড় বোন নাসরীন পারভীন মাস্টার্স সম্পন্ন করে এখন গৃহিণী। একমাত্র ছোট ভাই ড. লিয়াকত হোসেন জুয়েল বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। অপর দুই ছোট বোন গুলশানা পারভীন এবং এবং উম্মে সালমাও লেখাপড়া শেষ করে এখন গৃহিণী।
বাবার চাকরির সুবাদে রোখসানা বেনজুর শৈশব ও কৈশোরের বেশিরভাগ সময় কাটে পিরোজপুর জেলায়। পিরোজপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেনি পরযন্ত লেখাপড়া করে বরগুনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে মানবিক বিভাগে ফার্স্ট ডিভিশন নিয়ে এসএসসি পাস করেন রোখসানা বেনজু।
বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮১ সালে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেন তিনি। ১৯৮৮-৮৯ শিক্ষাবর্ষে এলএলএম সম্পন্ন করে নবম বিসিএসে উত্তীর্ণ হন। ১৯৮৯ সালে সহকারী জজ হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।
চাকরি জীবনে দেশের বিভিন্ন জেলায় দায়িত্ব পালনকালে ২০১৪ সালে শরিয়তপুর জেলার প্রথম নারী ও শিশু নির্যতন দমন ট্রাইবুনালের জেলা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রথম নারী ও শিশু নির্যতন দমন ট্রাইবুনালের জেলা জজের দায়িত্বপালন করেন। এরপরেই সবুজ পাহাড় আর নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যর আধার খাগড়াছড়ি জেলার প্রথম নারী জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্বপালন করেন তিনি। বর্তমানে পটুয়াখালী জেলার প্রথম নারী জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রোখসানা বেনজু।
রোখসানা বেনজুর তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে মাঈশা অরণি এলএলএম সম্পন্ন করে বিসিএস-এর জন্য প্রস্ততি নিচ্ছেন। মেজ ছেলে মাহির অরিত্র চিটাগং ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি(চুয়েট)এর আর্কিটেকচার বিভাগের শেষ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। ছোট ছেলে মাহদি অনন্য সবে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
বিচার বিভাগীয় চাকরির পাশাপাশি বরগুনা জেলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে এসেছেন রোখসানা বেনজু। বরগুনার অসংখ্য দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি নিভৃতে নি:রবে। বরগুনার একজন অদম্য নারী রোখসানা বেনজুর আত্মপ্রচেষ্টায় ঘুরে দাড়ানোর গল্প, দীপ্ত শপথের এগিয়ে চলার গল্প, বরগুনার নারী সমাজের প্রেরণা হয়ে থাকবে।
লেখকঃ প্রকৃতি প্রেমিক ও সাংবাদিক। (০৭-০৭-২২)