স্টাফ রিপোর্টার
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ঘরে বসে অনলাইনেই সেরে নেওয়া যাচ্ছে যাবতীয় কার্যক্রম। সরকারের নানামুখী উদ্যোগে দুর্ভোগ ও সময় বাঁচিয়ে জনসাধারণের দোরগোড়ায় নানা সেবা মিলছে নিমিশেই।
বর্তমান সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়নের সঙ্গে প্রতিটি সেক্টরেই লেগেছে ‘ডিজিটাল’ ছোঁয়া। নতুন শতাব্দির নানা চ্যালেঞ্জের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে যাচ্ছে পুলিশি সেবাও।
এখন থেকে ঘরে বসেই যে কেউ পুলিশি সেবার অন্যতম প্রধান কাজ এফআইআর ও জিডির কাজটি সেরে নিতে পারবেন। ‘অনলাইন জিডি’ নামে সদ্য চালু হওয়া এই সেবার মাধ্যমে পুলিশ আরও ‘জনবান্ধব’ হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমান সরকারের ভিষণ-২০২১ লক্ষ্য ঘোষণায় ২০১০ সালেই সারাদেশে প্রতিটি থানায় ইলেকট্রনিক এফআইআর ও জিডি চালুর পরিকল্পনা করে। দীর্ঘমেয়াদী ১০টি বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম লক্ষ্য ছিল ‘২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের সব থানায় ইলেকট্রনিক জিডি ও এফআইআর চালু’ করা।
মঙ্গলবার (২১ জুন) বিকেলে রাজারবাগ পুলিশ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে ‘অনলাইন জিডি’ নামে সে কার্যক্রমেরই উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের আধুনিকায়নের যুক্ত হওয়া অনলাইন জিডি কার্যক্রমের সফটওয়্যারটি সিডিএমএস++ সফটওয়্যারের সঙ্গে এপিআই-এর মাধ্যমে সংযুক্ত। ২০১১ সালে সিডিএমএস সফটওয়্যার তৈরি করা হয়, যা বর্তমানে বাংলাদেশের সব থানায় দায়েরকৃত এফআইআর ও তদসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্যাদির ডিজিটাল রেকর্ড হিসেবে কেন্দ্রীয়ভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে।
দেশের যেকোনো থানায় বসেই কোনো সন্দেহভাজন সম্পর্কে বাংলাদেশের বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে কি ধরনের মামলা রয়েছে তার আপডেট জানা এখন মাঠ পুলিশের কাছে একটি নৈমিত্তিক বিষয়।
অনলাইন জিডির বর্তমান সফটওয়্যারটির নির্মাণ শুরু হয় ২০১৯ সালে। ২০২০ সালের জুন থেকে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয়। ২০২২ সালের ২১ জুন সামগ্রিকভাবে এর উদ্বোধন করা হলো।
অনলাইন জিডি করবেন যেভাবে
প্রথমে প্লে স্টোর থেকে ঙঘখওঘঊ এউ নামক সফটওয়্যার ইনস্টল করতে হবে। এরপর নিজের মোবাইল নাম্বার ও মনে রাখার সুবিধা মতো পাসওয়ার্ড দিয়ে এবং অন্যান্য নির্দেশনা অনুসরণ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে। এরপর নির্ধারিত ছকের তথ্যসমূহ পূরণ করে অনলাইন জিডির তথ্যাদি এন্ট্রি করতে হবে।
নিবন্ধন অপশনে গেলে মিলবে আরও চারটি অপশন। সেখানে আছে জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, পাসপোর্ট ও বিদেশি পাসপোর্ট। তবে আপাতত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যে নিবন্ধন করা যাচ্ছে।
জাতীয় পরিচয়পত্রের অপশনে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার জন্ম তারিখ ও পরিচয়পত্র যাচাই করে ব্যবহারকারীর জেলা থানা ইউনিয়ন গ্রাম ও ঘটনার বিবরণ সংক্রান্ত তথ্য বিবরনী দিতে হবে।
অনলাইনে জিডি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ব্যবহারকারী পাবেন সার্ভিস কোড। অল্প সময়ের মধ্যেই অ্যাপস এর মাধ্যমে অনলাইনে কিউ-আর কোড সম্বলিত জিডির কপি সংগ্রহ ও মুদ্রণ করা যাবে। সফটওয়্যার ছাড়াও অনলাইন জিডি করা যাবে এউ.চঙখওঈঊ.এঙঠ.ইউ এইখানেও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অনলাইন জিডি সুবিধাসহ ১৩টি ফিচার নিয়ে সিডিএমএস++ বাংলাদেশ পুলিশের নিজস্ব উদ্যোগে সিডিএমএস টেকনিক্যাল কমিটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মিত একটি অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার। সফটওয়্যারটির মোবাইল অ্যাপস ও ওয়েব সংস্করণ ব্যবহার করে সেবাগ্রহীতা ঘরে বসেই জিডিযোগ্য বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ রেকর্ড করতে পারবেন এবং এ বিষয়ে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরবর্তী আপডেট জানতে পারবেন।
অন্যদিকে থানায় দায়িত্বরত ডিউটি অফিসার অভিযোগ প্রাপ্তির ব্যবস্থা গ্রহণসহ থানার সব কার্যক্রম ডিজিটাল জেনারেল ডায়রিতে এন্ট্রি করবেন এবং পিআরবি প্রবিধি মোতাবেক ২০০ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট জেনারেল ডায়রি বই বাঁধাই করে সংরক্ষণ করবেন। একইসঙ্গে থানার ওসি, সার্কেল বা জোনাল অফিসার পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ তাদের সার্বিক তদারকি কার্যক্রম সম্পাদন করতে পারবেন।
৬৬২ থানায় অনলাইন জিডির দেখভাল করবেন ৬ হাজার ৬০০ পুলিশ
করোনা মহামারির মধ্যেও অনলাইন জিডির কাজ বন্ধ রাখেনি পুলিশ। পুলিশ স্ব উদ্যোগে ৬৪ জেলায় ৮ মেট্রোপলিটন ও ৬৬২ থানায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক জনবলকে প্রশিক্ষিত করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে এবং সরকারের লক্ষ্য অর্জনে প্রশিক্ষিত জনবলে অনলাইন জিডি চালু করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়।
সিডিএমএম++ যে ১৩টি ফিচার রয়েছে
১. অনলাইন জিডি
২. জিডি সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান ও তদারকি কার্যক্রম
৩. হারানো ও প্রাপ্তি সংক্রান্ত ম্যাচিং রেকর্ড উপকারভোগীকে স্বয়ংক্রিয়-অবহিতকরণ
৪. অশনাক্ত লাশ শনাক্তে ফটো-ম্যাচিং সুবিধা
৫. মৃতের শরীরের বিভিন্ন অংশের ৩২টি ছবিসহ ভয়েস-টাইপে স্বয়ংক্রিয় সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি৷
৬. ডিজিটাল মানচিত্রে সন্দেহভাজনদের আবাসন চিহ্নিতকরণ
৭. বিট পুলিশিংসহ টহল দলের গতিবিধি অনলাইন-মানচিত্রে সরাসরি নিরীক্ষণ।
৮. পুলিশের ছুটি ও সিসি ব্যবস্থাপনা
৯. অটো আপডেটিং পুলিশ ফোনবুক
১০. পুলিশের সুষম দায়িত্ব বন্টন ব্যবস্থা
১১. পুলিশের দক্ষতা-পরিমাপক কর্ম-মূল্যায়ন ব্যবস্থা
১২. পুলিশের জন্য সিমবিহীন বহুমুখী আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা
১৩. অবস্থান চিহ্নিতকরণ ও লাইভ-ফটো ম্যাচিং সুবিধাসহ পুলিশের ডিজিটাল হাজিরা।
অনলাইন জিডির বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন বলেন, ভিশন-২০২১ অনুযায়ী টেকশই, অংশগ্রহণমূলক ও দারিদ্র-নিরোধী উন্নয়নের জন্য যেকোনো সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিনির্ভর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ পুলিশ বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্ত ও গোয়েন্দা তথ্য নির্ভর পুলিশিংয়ে অনেক সাফল্য অর্জন করেছে এবং এ লক্ষ্যে নিরন্তর প্রয়াশ অব্যাহত রেখেছে। এর অন্যতম হল অনলাইন জিডি। জনপ্রত্যাশা পূরণে এ পদক্ষেপ একটি মাইলফলক।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, পুলিশ বর্তমানে প্রতিরোধমূলক পুলিশিংয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপক সক্ষমতা অর্জন করেছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের কারণে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা পুলিশের অর্জন করা মুজিববর্ষের শ্রেষ্ঠ উপহার।
তিনি বলেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনলাইন জিডি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে অনুসন্ধানে গুণগত মান উন্নয়ন ও তদন্তে গতিশীলতা আনতে সক্ষম হবেন। একই সঙ্গে তদারককারী কর্মকর্তাগণ এ সফটওয়্যারের সহায়তায় অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবেন। এতে বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে। তাছাড়া সেবা প্রার্থী জনগণ অতি সহজে এ সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বাংলাদেশের সর্বসাধারণের জন্য বাংলাদেশ পুলিশের নতুন উপহার অনলাইন জিডি দেশরক্ষায় আত্ম-নিবেদিত পুলিশ বাহিনীর জন্য নতুন এক মাইলফলক।
তিনি আরও বলেন, থানায় উপস্থিত হয়ে জিডি করার বিষয়টি বহুদিন ধরে চলে আসছিল। অনলাইন জিডি মাধ্যমে মানুষজন এখন ঘরে বসে জিডি করতে পারবেন। অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত ঘরে বসে অনলাইনে জিডির সব কার্যক্রম মানুষজন দেখতে পারবে। এভাবে সরকারি সেবা জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি।